বিলুপ্তির পথে শেরপুরের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর তাঁত শিল্প।

সোহাগী আক্তার | প্রকাশিত: ২৪ ডিসেম্বর ২০২০ ০৫:২৬; আপডেট: ২৪ ডিসেম্বর ২০২০ ০৫:৩৫

ছবিঃ সংগৃহীত

কাঁচামালের দাম বৃদ্ধি ও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে বিলুপ্তির পথে শেরপুরে সীমান্তবর্তী গারো পাহাড় এলাকার ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যবাহী তাঁত শিল্প। একসময় গারো পাহাড়ের বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী পল্লিতে দিন-রাত এসব তাঁতের খটখট আওয়াজ পাওয়া গেলেও এখন সে শব্দতো দূরের কথা, তাঁত শিল্পের সঙ্গে জড়িত কারিগর ও তাঁতের কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়াই ভার হয়ে উঠেছে। গ্রামগুলোয় ধ্বংসস্তুপের মতো পড়ে থাকতে দেখা যায় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ঐতিহ্যের ধারক-বাহক তাঁত মেশিনগুলো। একসময় এ এলাকার গারো, কোচ, ডালু, বানাই, হদি, বর্মণসহ বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষ নিজেদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক নিজেরাই তৈরি করে ব্যবহার করত। যাদের তাঁত ছিল না তারা গ্রামের ওইসব তাঁতের তৈরি গামছা, লুঙ্গি, মেয়েদের ওড়না দক শাড়ি, দক মান্দা, বিছানার চাদরসহ বিভিন্ন পোশাক কিনে ব্যবহার করতেন।

সূত্র মতে, শেরপুর জেলার সীমান্তবর্তী গারো পাহাড় এলাকার নালিতাবাড়ী, ঝিনাইগাতী ও শ্রীবরদীসহ জেলা সদর ও নকলা উপজেলা মিলিয়ে প্রায় ২০ হাজার ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সদস্যের বসবাস। এর মধ্যে পাহাড়ি এলাকার ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী শত শত বছর ধরে তাদের ঐতিহ্য ধরে রেখে নিজেদের পোশাক নিজেরাই তৈরি করে ব্যবহার করে আসছিল। কিন্তু জীবন-জীবিকার তাগিদে এসব তাঁতশিল্প ছেড়ে অন্য পেশায় চলে যাওয়ায় ও সুতার মূল্য বৃদ্ধিসহ নানা প্রতিকূল পরিবেশের কারণে এ এলাকার ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী বিশেষ করে গারো ও কোচ সম্প্রদায়ের মানুষ প্রায় আট থেকে দশ বছর আগেই তাদের সে ঐতিহ্যের তাঁত বন্ধ করে দেয়। ফলে গারো ও কোচ সম্প্রদায়ের বাড়িতে ঘূণ ধরা কাঠের তাঁতগুলো এখন পড়ে আছে। তাঁতিদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, এখনও তাদের এ ঐতিহ্য এবং শিল্পকে রক্ষা করতে হলে সরকারের সুদৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন। অবশ্য অনেক আগেই এ শিল্পের কারিগররা অন্য পেশার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল। অনেকে কাজের সন্ধানে ঢাকায় পাড়ি জমিয়েছেন।

ঝিনাইগাতি উপজেলার রাংটিয়া কোচপাড়ার জাগেন্দ্র কোচ বলেন, "আট বছর আগে আমার আটটি তাঁত ছিল। আমার গামছা, লুঙ্গি, নারীদের ওড়না, শাড়ি, বিছানার চাদরসহ বিভিন্ন পোশাক বুনতাম। কিন্তু সুতার মূল্য বেড়ে যাওয়ায় আমাদের অনেক খরচ পড়ে যেত। শ্রমিকরাও তাদের মজুরিতে না পোশানোয় তারা অন্য পেশায় চলে যান। আবার টেক্সটাইলের শাড়ি-লুঙ্গির দাম অনেক কম থাকায় আমাদের গোত্রের লোকজন সেই পোশাকের দিকে ঝুঁকে পড়ে। ফলে আমাদের এ তাঁত আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে যায়"। জীবিকার তাগিদে খরচ বাঁচাতে তাঁত বন্ধ করতে হয়েছে বলে জানান তিনি। একই গ্রামের তাঁত শ্রমিক প্রণব কোচ বলেন, "আমি তো অনেক আগেই ঢাকায় একটি হোটেলে বাবুর্চির চাকরি করছি। এলাকার তাঁতগুলো আবার চালু হলে ঢাকায় আর থাকতাম না"। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী নারী রায়তি বলেন, "আমরা আমাদের ঐতিহ্যবাহী দক শাড়ি পরা বাদ দিয়ে বাঙালিদের শাড়ি পরতে বাধ্য হইছি। এহন এ তাঁত চালু হলেই আমাগো ভালো হইতো"। 

পরিত্যক্ত তাঁত

এ বিষয়ে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কোচ নেতা যোগেন কোচ বলেন, "আমাদের ঐতিহ্যের তাঁত ও পোশাক রক্ষায় একসময় কারিতাস কিছু সহযোগিতা করলেও এখন আর কেউ খোঁজ নিচ্ছে না। তবে সরকার থেকে কোনো সহযোগিতা পেলে আবার আমাদের এ ঐতিহ্য ফিরে পেতে পারে। ইতোমধ্যে দেশের পার্বত্য এলাকার চাকমা ও মণিপুরী তাঁত সরকারি-বেসরকারি নানা সংস্থার সহযোগিতায় বিলুপ্তির হাত থেকে বেঁচে উঠেছে। আমরাও চাই আমাদের শেরপুরের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের প্রতি সরকারি-বেসরকারি কোনো সংস্থা সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিক"। এ বিষয়ে জানতে চাইলে শেরপুর বিসিক শিল্প নগরীর কর্মকর্তা এসএম রেজুয়ানুল ইসলাম বলেন, "আমরা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের ঐতিহ্য ও তাঁত শিল্পের জন্য সব ধরনের সহযোগিতা করব। তারা যদি তাদের এ শিল্পকে রক্ষায় আমাদের কাছে আসে তাহলে আমরা বিপণন ও ঋণ সহায়তা দিতে পারব"।



বিষয়:



এই বিভাগের জনপ্রিয় খবর
Top