নামকরন ও প্রতিষ্টাকাল বাংলাদেশের স্থাননাম খুবই চমৎকার – পাহাড়পুর, মধুপুর, সাতগাঁও, সোনারগাঁও, সুন্দরবন, সাগরগাঁও ইত্যাদি ।পাশাপাশি নদ-নদীর নামও সুন্দর – সুরমা, যমুনা, মেঘনা, ধলেশ্বরী, ধানসিঁড়ি, কীর্তিনাশা, কর্ণফুলী, কপোতাক্ষ, আড়িয়াল খাঁ, ব্রহ্মপুত্র প্রভৃতি । এই সব নদ-নদী, মা্ছ, ফু্ল, পাখি, বৃক্ষ, পাহাড় বা পর্বতের নামের উৎপত্তির ইতিহাস যেমন আছে তেমনি বাংলাদেশের সকল স্থাননামেরও ঊৎপত্তির ইতিহাসও আছে।
স্থাননামের উৎপত্তির ইতিহাস অনুসন্ধান বা উৎসের সন্ধান করতে গিয়ে সৈয়দ মুর্তুজা আলী বলেছেন, ‘যদি কোন নামের সঙ্গে তার ভূ-প্রকৃতির সঙ্গতি না থাকে, তা হলে উক্ত নামের উৎপত্তির ইতিহাস গ্রহনযোগ্য নয়’ । এই যে ভূ-প্রকৃতির কথা বলা হল এটি অনেকাংশে সত্য । বাংলাদেশে ভূ-প্রকৃতির সাথে সঙ্গতি রেখে অনেক স্থানের নাম হয়েছে । লালমাটিয়া, রাঙামাটি প্রভৃতি ভূমির ক্ষেত্রে এবং সেগুনবাগিচা, শিমুলিয়া, জামতলি ইত্যাদি প্রকৃতির সাথে সম্পর্কিত স্থান নাম । দেখা গেছে ভূ-প্রকৃতির পরিবর্তনের সাথে সাথে স্থান নামেরও পরিবর্তন হয় ।আগের চন্দ্রদীপ বর্তমানে বরিশাল । স্থান নামের উৎপত্তি নানাভাবে হয় ।তেঁতুল থেকে তেঁতুলিয়া, কাপাস থেকে কাপাসিয়া, নীলচাষ থেকে নীলক্ষেত, বেগুন থেকে বেগুনবাড়ি, আবার কখনো রং এর নামে সবুজবাগ, লালবাগ, নীলগঞ্জ । ঘাটের নাম সোয়ারিঘাট, বাহাদূরাবাদঘাট ।

আবার বিভিন্ন পেশার মানুষের বসবাসের এলাকা , পাড়ার নামকরণ করা হয় এভাবে – কুমারপাড়া, কামারপাড়া, জেলেপাড়া, তাঁতিপাড়া ইত্যাদি। বাংলাদেশে অনার্যদের বসবাসের সময় দেখা গেছে তাদের গোত্রপ্রধান বা দল প্রধানের নামে স্থানের নাকরণ হয়েছে । এখনো ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের বসবাসের এলাকা তাদের গোত্র প্রধান বা রাজা বা কারুর নামে অথবা তাদের কোন নিজস্ব জাতির শব্দের নামে নামকরণ হয়েছে । যেমন – শেরপুর জেলার ঝিনাইগাতির কোচ, গারো ও হাজং এলাকায় একটি স্থানের নাম রাংটিয়া ।
হিন্দুদের রাজত্বকালে তাদের দেব-দেবীর নামানুসারে অনেক স্থানের নাম হয়েছে _ শিবচর, দুর্গাপুর, লক্ষীপুর, রামপুর, হরিপুর ইত্যাদি। পরবর্তীকালে মুসলমান শাসকদের শাসনামলে তাদের নামে অনেক স্থানের নামকরণ হয়েছে- জাহাঙ্গীরনগর, নাসিরাবাদ, নবাবগঞ্জ প্রভৃতি । ইংরেজ আমলে ঢাকা শহরের কয়েকটি রাস্তার নাম হয়েছে- মিন্টু রোড, ফুলার রোড, বেইলি রোড, র্যাংটিন রোড, , তেমনি পাকিস্তান আমলে হয়েছে- উর্দু রোড, পাক মটর । আবার দেখা যায় শাসক ও শাসন পরিবর্তন হলে স্থানের নামের পরিবর্তন হয় । যেমন বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর পাকমটর হয়েছে বাংলামটর, পাকিস্তান মাঠ বাংলামাঠ হয়েছে । তেমনি হয়েছে বাংলা কলেজ । আইয়ুব গেট থেকে আসাদ গেট, জিন্নাহ এভিনিউ থেকে বঙ্গবন্ধু এভিনিউ ।স্থান নামের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেছে ব্যক্তির নাম। বিশেষ করে বিভিন্ন গোত্র প্রধান, সমাজ অধিপতি, জমিদার, রাষ্ট্র প্রশাসকদের নামানুসারে বাংলাদেশের অনেক স্থানের নামকরণ করা হয়েছে । সম্রাট আকবরের নামে আকবর নগর থেকে শুরু করে জমিদার শের আলী গাজীর নামে “শেরপুরের” নামকরণ এক্ষেত্রে বলা যায় । শের আলী গাজীর নামানুসারে শেরপুর।

নকলা গ্রামের নামানুসারে নকলা, অধিক পরিমাণ পাট উৎপাদনের সূত্রে নালিতাবাড়ি, সাধক সরওয়ার্দীর নামানুসারে শ্রীবর্দী, ঝি ঝি পোকার গোঞ্জন থেকে ঝিনাইগাতির নামকরণ হয়েছে এরুপ প্রচলিত। তবে শেরপুর ও শ্রীবর্দীর নামকরণ নিয়ে ভিন্ন মতামত ও রয়েছে। শেরপুর একটি প্রাচীন জনপদ। শেরপুরের আগের নাম ছিল “দশকাহনিয়া” । দশকাহনিয়া নামকরণ সম্পর্কেও নানা মতামত রয়েছে । ইতিহাস গবেষক অধ্যাপক দেলওয়ার হোসেন বলেছেন, “পূর্বকালে ব্রম্মপুত্র নদ অনেক প্রশস্ত ছিল ।বর্তমানকালের জামালপুর হইতে শেরপুর যাইতে হইলে সম্পূর্ণ পথ নৌকায় পাড়ি দিতে হইত । এই পারাপারের জন্য কাহনকরি নির্ধারিত ছিল বলে এই বিস্তৃত স্থান ‘দশকাহনিয়া’ নামে পরিচিত হয়”। দশকাহনিয়া সম্পর্কে আরও বলা হয়েছে যে, বর্তমান বগুড়া শেরপুরের (তখন মরিচা শেরপুর বলা হতো) করতোয়া নদী বিস্তৃত ছিল বর্তমান শেরপুর পর্যন্ত। (তখন ময়মনসিংহে দশকাহনিয়া শেরপুর) এই নদী পাড়ি দিতে যাত্রী-রা দশকাহন কড়ি দিতো বলে, ময়মনসিংহ শেরপুরের নাম দশকাহনিয়া শেরপুর হয়েছে । আবার কোন কন ঐতিহাসিকের মতে, এই অঞ্চলের প্রজাদের উপর দশকাহন কড়ি বার্ষিক খাজনা ধার্য ছিল সেখান থেকে দশকাহনিয়া হয়েছে । দশকাহনি শেরপুর ।
এই শেরপুরের নামকরণ সম্পর্কে ইতিহাসবিদ ও পন্ডিতরা বলেছেন, দিল্লির আকবর বাদশা খাতক মনসবদারী প্রদান করে দ্বাদশ পরিষদসহ বাংলাদেশের প্রেরন করেন । এই বারো জনের মধ্যে চারজন গাজী ও চারজন মজলিস বংশীয় পরিষদ ছিলেন । ঈশা খাঁর মৃত্যুর পর সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগেই গাজীগণ শেরপুর ও ভাওয়াল পরগনা গ্রহণ করেন । নাসিরুজিয়াল ও খালিয়াজুরি পরগানা মজলিসগণের ভাগে পড়ে । এই গাজী বংশের শেষ জমিদার ছিলেন শের আলী এবং তার নামানুসারে দশকাহনিয়া মহালের নতুন নাম হয় শেরপুর । একই তথ্য মেলে অন্যত্র, সৈয়দ মুর্তুজা আলী বলেছেন, ‘ময়মনসিংহের শেরপুরের নামকরণ হয়েছে ভাওয়ালের জমিদার শের আলী গাজী থেকে’ এই শেরপুর তখন একটি পরগনা ছিল, তারপর জমিদার প্রথা বিলুপ্তির পর পৌর শহর শেরপুর, মহকুমা শেরপুর । পন্ডিত ফসিহুর রহমান বলেছেন, ‘শেরপুর, নকলা, নালিতাবাড়ি, ঝিনাইগাতি ও শ্রীবরদী উপজেলার সমন্বয়ে ১৯৮৪ সালের ১২ ই ফেব্রুয়ারি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে জেলা শেরপুর । জেলার পাঁচটি উপজেলায় ৫২ টি ইউনিয়নে মোট ৬৭৮ টি গ্রাম রয়েছে। প্রত্যেকটি গ্রামের নামের উৎপত্তির ইতিহাস রয়েছে । শেরপুরের সর্ব দক্ষিণের গ্রামের নাম ‘চরখার চর’ । এক সময় এই গ্রামে চরখা দিয়ে সূতা তৈরি হতো সেই জন্য গ্রামের নাম চরখার চর । চরখার চরের পাশে গ্রাম বেতমারী । এই গ্রামে আগে বেতের চাষ হতো । জঙ্গলে ঘেরা বা জঞ্জল থেকে জংগলদি । ব্রম্মপুত্র নদের তীরবর্তী গ্রাম ছনকান্দা । নদীর তীরে প্রচুর ‘ছন’ চাষ হতো সে কারণে কান্দা বা টিলা উঁচু জায়গার নাম হয় ছনকান্দা ।কোন এক সময় বন্য হাতিকে ধরে গ্রামের মানুষ বেঁধে রেখেছিল বলে গ্রামের নাম হয়েছে হাতিবান্দা ।
