কর্মসূচির শ্রমিকের তালিকায় ইউনিয়ন পরিষদের উদ্যোক্তা আর গ্রাম পুলিশের নাম: লাখ লাখ টাকা লোপাটের শঙ্কা

মো: হারুন অর রশিদ | প্রকাশিত: ১৮ মে ২০২৩ ১৯:২৯; আপডেট: ২৭ জুলাই ২০২৪ ১৩:২৬

ছবি: সংগৃহীত

প্রায় ১০ বছরের অধিক সময় ধরে শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলার রামচন্দ্রকুড়া ইউনিয়ন পরিষদ ডিজিটাল সেন্টারের (ইউডিসি) উদ্যোক্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন সুকান্ত সরকার। আর কৃষ্ণ রবিদাস ও শ্রী রগবির দুজনেই ঐ একই ইউনিয়নের দফাদার ও চৌকিদার হিসেবে গ্রাম পুলিশের দায়িত্ব পালন করে আসছেন দীর্ঘদিন যাবৎ। ইউনিয়নের সরকারি ওয়েবসাইটেও রয়েছে তাদের নাম। অথচ তাদের সবার নাম খুঁজে পাওয়া গেল ঐ ইউনিয়নের অতিদরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান কর্মসূচি প্রকল্পের শ্রমিকের তালিকায়। এছাড়াও এক প্যানেল চেয়ারম্যানের স্ত্রীর নামও ঐ একই তালিকায় শ্রমিক হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

ঘটনাটি ঘটেছে শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলার রামচন্দ্রকুড়া ইউনিয়নের অতিদরিদ্রদের জন্য ৪০ দিনের কর্মসূচি প্রকল্পের কাজে। এছাড়া কাজে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগও উঠেছে। অতিদরিদ্রদের দিয়ে এ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করার কথা থাকলেও ইউনিয়ন পরিষদের উদ্যোক্তা, গ্রাম পুলিশের দফাদার, চৌকিদার, মেম্বারের স্ত্রী ও আত্মীয় স্বজনসহ নামে বেনামে শ্রমিকের তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে। ফলে প্রকৃত অতিদরিদ্র শ্রমিকরা হচ্ছেন উপেক্ষিত, দেখা দিয়েছে লাখ লাখ টাকা লোপাটের শঙ্কা।

উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, উপজেলায় অতিদরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান কর্মসূচির ২য় পর্যায়ে ৪৬ টি প্রকল্পের মোট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ২ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। প্রতিদিন ২০০০ জন শ্রমিক কাজ করার কথা। প্রতি শ্রমিকের দৈনিক মজুরি ৪০০ টাকা। এর মধ্যে শুধুমাত্র রামচন্দ্রকুড়া ইউনিয়নে ৪টি প্রকল্পে ১৫৬ জন শ্রমিকের জন্য সর্বমোট বরাদ্দ ২২ লাখ ৫৪ হাজার ৪০০ টাকা। ইউনিয়নটিতে উন্নয়নের জন্য লাখ লাখ টাকা বরাদ্দ এলেও যথাযথ বাস্তবায়ন না হয়ে লুটপাট হচ্ছে বলে অভিযোগ তুলেছে স্থানীয় সচেতন মহল।

রামচন্দ্রকুড়া ও মন্ডলিয়াপাড়া ইউনিয়নে ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে অতিদরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান কর্মসূচি (ইজিপিপি) দ্বিতীয় পর্যায়ে মোট ৪টি প্রকল্পের কাজ চলমান। সরেজমিন প্রকল্প ৪টি ঘুরে অর্ধেকেরও কম শ্রমিকের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। ইউনিয়নের পানিহাটা মিশন রোড উচু লাল মাটি হতে যোগ সাংমার বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা মেরামতএকটি প্রকল্পে ৩০ জন শ্রমিকের জন্য মোট ৪ লাখ ৩৪ হাজার টাকা বরাদ্দ। অথচ কর্মরত শ্রমিক পাওয়া গেছে মাত্র ১৫জন। প্রকল্পটিতে কর্মরত শ্রমিক হযরত আলী জানান, শুরু থেকেই ১৯ জন শ্রমিক কাজ করছে। বিভিন্ন কাজ থাকায় অনেকেই মাঝে মধ্যে অনুপস্থিত থাকেন। তাদের হাজিরা বা তদারকি করার জন্য খোঁজ খবরও রাখেন না কেউ। প্রকল্পের সভাপতি হামিদ মেম্বার শুরুর দিকে দুই একদিন আসলেও এখন আর আসেন না।

ঐ ইউনিয়নের তন্তর গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা শামছুল হকের বাড়ি হতে কান্দাপাড়া মসজিদ পর্যন্ত আরেকটি প্রকল্পে দেখা যায়, সেখানে ৬ লাখ ৬ হাজার ৮০০ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। ৪২জন শ্রমিকের কাজ করার কথা থাকলেও কাজ করছে মাত্র ১৬ জন। যদিও কর্মরত শ্রমিকরা জানিয়েছেন তারা শুরু থেকে ১৯ জন কাজ করেন। মাঝে মাঝে দুই তিনজন অনুপস্থিত থাকেন। বাকী ২টি প্রকল্পের বাস্তব চিত্রও একই রকম। কেরেঙ্গাপাড়া জামির সরকারের বাড়ি হতে মোতালেবের বাড়ি পর্যন্ত প্রকল্পটিতে ৪৫ জনের জন্য ৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা ও কালাকুমা খাদেমের বাড়ি হতে শাহজাহানের বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা মেরামত প্রকল্পতে ৩৯ জনের জন্য ৫ লাখ ৬৩ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। প্রকল্প দুটিতে যথাক্রমে ৪৫ জনের পরিবর্তে ৩২ জন ও ৩৯ জনের পরিবর্তে ২০জন নিয়মিত কাজ করছেন বলে কর্মরত উপস্থিত শ্রমিকরা জানিয়েছেন।

শ্রমিকের তালিকায় উদ্যোক্তার নাম থাকার বিষয়ে খোদ উদ্যোক্তা সুকান্ত সরকারের কাছে জানতে চাইলে তিনি তার নাম থাকার বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, কর্মসূচির শ্রমিকের তালিকার বিষয়টি চেয়ারম্যান মহোদয় জানেন। বিষয়টি চেয়ারম্যানই দেখভাল করেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ইউপি সদস্য জানান, কর্মসূচির প্রকল্পের কাজে দুর্নীতি হচ্ছে। কিন্তু এতে তারা লাভবান হতে পারছেন না। প্রকল্প শেষে মাত্র ১হাজার টাকা পান তারা। বাকি টাকার সুষ্ঠু হিসাব তারা জানেননা। তবে প্রকল্পের বরাদ্দের বড় একটি অংশের ভাগ দিতে হয় প্রকল্প সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রকল্প বাস্তবায়ন দপ্তরকে।

শ্রমিকের তালিকায় উদ্যোক্তা, গ্রাম পুলিশের নাম থাকার বিষয়ে ঐ ইউনিয়নের সচিব শফিকুল ইসলামের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন- ব্যস্ততার জন্য এবারের প্রকল্পের খবর নিতে পারিনাই। তবে চেয়ারম্যান সাহেব বিষয়টা বলতে পারবে। আর চৌকিদারদের মানবিকতার খাতিরে দুই একটা নাম দেওয়া হয়েছে হয়তো।

রামচন্দ্রকুড়া ও মন্ডলিয়াপাড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান খোরশেদ আলম খোকার কাছে শ্রমিকের তালিকায় অনিয়মের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বিষয়টি এড়িয়ে গিয়ে গ্রামের এইসব ছোট খাটো বিষয়ে খোঁজ না করে বড় বড় বিষয়ে লেখালেখি করতে পরামর্শ দেন।

উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা আব্দুল হান্নান বলেন, বিষয়টি আগে জানা ছিলো না। যদি এমন ঘটনা হয়ে থাকে তবে বিষয়টি দেখা হবে।





এই বিভাগের জনপ্রিয় খবর
Top