পার্ক হোক শিশুবান্ধব।

আরমান হোসেন | প্রকাশিত: ২৭ ডিসেম্বর ২০২০ ২২:৩১; আপডেট: ২৮ ডিসেম্বর ২০২০ ০৮:১৬

ছবিঃ সংগৃহীত

এসেছে নতুন শিশু, তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান;

জীর্ণ পৃথিবীতে ব্যর্থ, মৃত আর ধ্বংসস্তূপ-পিঠে

চলে যেতে হবে আমাদের।
চলে যাব- তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ
প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল,
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।

কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য তার "ছাড়পত্র" কবিতায় ঠিক এভাবেই এই পৃথিবীকে নবাগত শিশুর বাসযোগ্য করে যাওয়ার অঙ্গিকার করে গেছেন।

কবির এই মহৎ ইচ্ছার সাথে আমরা কতটা অঙ্গিকারাবদ্ধ? কতটাই বা আমরা এই পৃথিবীকে আগামী দিনের ভবিষৎ শিশুদের বাসযোগ্য করতে পেরেছি?

করোনাকালীন সময়ে কিছুটা একগেয়েমি দূর করতে কিছুদিন আগে বাগদত্তাকে নিয়ে ঘুরতে গিয়েছিলাম শেরপুর শহর ঘেষে গড়ে উঠা শহীদ দারোগ আলী পৌর পার্কের পৌর চিলড্রেন কর্ণারে (শিশু পার্ক)। এর আগে কখনো সেখানে যাই নি বলে জায়গাটা আমার কাছে একদমই নতুন। জায়গাটি অবশ্য নির্ধারণ করে ছিলেন আমার বাগদত্তা। শিশু পার্ক নামটা শুনে প্রথমে কেমন যেন লেগেছিল, পরে সঙ্গিনীর কথাতে রাজি হয়ে গেলাম।
বাসা থেকে বের হয়ে রিকশা নিয়ে উঠে পড়লাম। মাত্র কয়েক মিনিটের ব্যবধানে পৌঁছে গেলাম। রিকশা থেকে নামতেই অবাক হয়ে গেলাম, আমার চক্ষুগোলক বড় হয়ে গেল। একি! এটা তো শহরে আবদ্ধ জীবন কাটানো শিশুদের বিনোদনের জন্য পার্ক! এখানে আমরা কেন? বাগদত্তার কথা শুনে যা বুঝলাম, ভেতরে গেলেই বুঝা যাবে!

টিকেট কেটে ভেতরে ঢুকলাম। ভেতরে ঢুকেই নিজেকে ভিন্ন জগতে অবিষ্কার করলাম। "শিশু পার্ক" এর নতুন সংজ্ঞা খুঁজে পেলাম আমি। পুরো পার্ক যুবক-যুবতী আর প্রেমিকযুগল দিয়ে ভরা। নামটা "প্রেম পার্ক" দিলে নিশ্চয় ভুল হতো না। প্রেমিক-প্রেমিকারা জুটি বেঁধে বসে আছে শিশুদের বিনোদনের জন্য বসানো সরঞ্জামাদিতে।

আমি প্রেম-ভালবাসার বিরুধীতা করছি না, আমি বিরুধীতা করছি শিশু পার্কে বেহায়াপনাকে বা অপেনলি ফ্রি মিক্সিং কে। এটা কখনোই কোনো ভাল বা শিক্ষাসুলভ আচরণ নয়। এই পার্কে শিশুরা আসবে, তারা যা দেখতে তা-ই শিখবে বা তাদের চিন্তাধারাতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

আমি আর আমার বাগদত্তা কোনো মতে বসার জায়গা পেয়ে বসলাম। সেখানে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিতকরণের ছিটেফোঁটাও ছিল না। বলে রাখা ভাল, আমরা মাস্ক পরিধান করেছিলাম। আমরা বসতে বসতেই ১০-১২ জন শিশু আসল আর আগে থেকেই ভেতরে ৪-৫ জন শিশু ছিল। তারা যুবক-যুবতীদের জুটির ভিড়েই যতটুকু পারা যায় খেলাধুলা করতে শুরু করল।

আমি আমার বাগদত্তাকে বললাম, এখানে আমরা না আসলেও পারতাম। জবাবে সে বলল, সবাই এখানে আসে। শিশুপার্ক বা চিলড্রেন কর্ণারে আমাদের কাজ কী তা আজও আমার বোধগম্য নয়!
জার্মান ভিত্তিক আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ডয়চে ভেলের একটি আর্টিকেল পড়েছিলাম যেটার শিরোনাম ছিল, "শিশুদের পার্ক নাকি ‘শিশু তৈরির পার্ক'!" কথাটি কেমন শুনতে লাগলেও যথোপযুক্ত। অশ্লীলতা কেমন যেন সাধারণ ব্যাপার হয়ে উঠেছে। পার্কের ভেতর যৌন উস্কানিমূলক গান চলছে, প্রেমিক-প্রেমিকারা রোমান্টিকতায় ব্যস্ত পাশেই শিশুরা খেলাধুলা করতেছে, চিন্তা করা যায়?

সঙ্গিনী জানালেন একসময় সে তার ছোট ভাই-বোনকে নিয়ে বাবা-মার সাথে পার্কে আসতেন অবসর সময় কাটাতে, খেলাধুলা করতে। শিশুপার্কের পরিবেশ এখন আগের মত শিশুবান্ধব নেই বলে এখন আর আসেন না। শহরের একমাত্র শিশুপার্কের এই অবস্থা হলে শিশুরা যাবে কোথায়?

কিছুদিন আগে, করোনাকালীন সময়ে অভিভাবকদের উদ্দেশ্যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেন, "আমি সব মা-বাবা বা অভিভাবককে বলব, যেহেতু করোনাভাইরাসের কারণে তারা স্কুলে যেতে পারছে না, তাই আপনারা কাছাকাছি কোনো পার্কে নিয়ে যাবেন। সেখানে দিনে অন্তত এক ঘণ্টার জন্য হলেও ছোটাছুটি বা খেলাধুলা তারা করতে পারে, সে সুযোগটা সৃষ্টি করে দেওয়া দরকারি বলে আমি মনে করি। কারণ, তাদের স্বাস্থ্য এবং মানসিক অবস্থার জন্য সবদিক থেকেই এটা খুব দরকার।" (দৈনিক প্রথম আলো, ৬ই অক্টোবর)

শিশুদের মানসিক বিকাশ থেকে শুরু করে বেড়ে উঠা, শারীরিকভাবে সুগঠিত হওয়ার জন্য খেলাধুলার গুরুত্ব অপরিসীম। তাই খেলাধুলার জন্য দরকার শিশুপার্ক। এই পার্ক অবশ্যই শিশুবান্ধব হওয়া উচিত। কেননা, এমনিতেই এই যুগের শিশুরা ঘরমুখী, তারা ঘর হতে বের হতে চায় না। ভিডিওগেমসের আসক্তি তাদের ঘর হতে বের হতে দেয় না, তার উপর ইন্টারনেটের প্রভাব ত রয়েছেই। এই ব্যাপারে এখনই সময় অভিভাবকদের সচেতন হওয়া এবং তাদের শিশুদের জন্য কোনটা ভালো সে ব্যাপারে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া।

সকলের প্রতি অনুরোধ থাকবে, আসুন আমাদের ভবিষৎ প্রজন্মকে আমরা সঠিকভাবে মানুষের মত মানুষ হিসাবে গড়ে তুলি। শিশুদের অশ্লীলতার প্রভাব থেকে দূরে রাখি, তাদের মানসিক বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখি। সর্বোপরি, শেরপুরের নগর পিতার সুদৃষ্টি কামনা করছি শহীদ দারোগ আলী পৌর পার্কের শিশুপার্ক বা চিলড্রেন কর্ণার এর প্রতি।

লেখকঃ তরুণ কলামিস্ট, লেখক, অপেশাদার সাংবাদিক
ও সাবেক শিশু সাংবাদিক, বিডিনিউজ টুয়েন্টিফোর ডটকম।



বিষয়:



এই বিভাগের জনপ্রিয় খবর
Top