ভালবাসার অনন্য নিদর্শন;

নালিতাবাড়ীর ঐতিহাসিক সুতানাল দীঘি।

মোঃ হারুন অর রশিদ | প্রকাশিত: ২৪ অক্টোবর ২০২০ ২০:২২; আপডেট: ২৫ অক্টোবর ২০২০ ০০:০৬

সুতানাল দিঘী
শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলার অন্যতম ঐতিহাসিক দীঘি হলো কমলা রাণীর দীঘি বা সুতানাল দিঘি বা বিরহীনি দীঘি। দীঘিটি কে কখন কোন উদ্দেশে খনন করেছিলেন- তার ইতিহাসনির্ভর নির্দিষ্ট কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে এলাকার বয়োজ্যেষ্ঠদের কাছ থেকে জানা যায়, মোঘল আমলের শেষের দিকে আনুমানিক খৃষ্টীয় ত্রয়োদশ শতাব্দীতে মধ্যমকুড়া গ্রামে সশাল নামে এক গারো রাজা রাজত্ব করতেন। তাঁর আমলেই এই দীঘি খনন করা হয়। কারো কারো দাবী এখানে বৌদ্ধ বিহার ছিলো। পরিখার মতো বিশাল এ দীঘিটি খনন করা হয়েছিল ১৮০ বিঘা জমির উপর। কথিত আছে রাজার শেষ বংশধর ছিলেন তাঁর রাণী বিরহীনি। হঠাৎ একদিন রানি বিরহিণী সামন্ত রাজাকে উদ্দেশ্য করে বলেন, তুমি কী আমাকে ভালবাসার নিদর্শন হিসেবে কিছু দিতে চাও? তাহলে এমন কিছু দান কর যা যুগ-যুগ ধরে মানুষ আমাকে মনে রাখবে। তখন রাজবংশী সামন্ত রাজা রানিকে খুশি করার জন্য সিদ্ধান্ত নিলেন। 
 
চরকীর সাহায্যে অবিরাম একদিন একরাত সুতা কাটা হবে। দৈর্ঘে যে পরিমাণ সুতা হবে। সেই পরিমাণ সুতার সমান লম্বা এবং প্রশস্ত একটি দীঘি খনন করা হবে। ওই দীঘির পানি জনগণ ব্যবহার করবে আর তোমাকে স্বরণ করবে। রানীর সম্মতিতে পরিকল্পনা অনুযায়ী দীঘির খনন কাজ শুরু হল। দিনের পর দিন খনন কাজ চলতে থাকল। নির্মিত হল বিশাল এক দীঘি। এই দীঘির এক পাড়ে দাঁড়ালে অন্য পাড়ের মানুষ চেনা যায় না।
 
 
আরো কথিত আছে, খননের পর দীঘিতে জল ওঠেনি। জল না ওঠায় সবাই যখন চিন্তিত। তখন কমলা রানী স্বপ্নাদেশ পেলেন- ‘গঙ্গাপূজা কর নরবলি দিয়া, তবেই উঠিবে দীঘি জলেতে ভরিয়া।’ এমন স্বপ্ন দেখে রানী চিন্তিত হয়ে পড়েন। তখন তিনি নরবলি না দিয়ে নিজেই গঙ্গামাতাকে প্রণতি জানানোর জন্য মহা-ধুমধামে বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে দীঘির মাঝখানে গঙ্গাপূজার আয়োজন করেন। কমলা রানী গঙ্গামাতার পায়ে প্রার্থনা জানিয়ে বলেন, ‘কোন মায়ের বুক করিয়া খালি, তোমাকে দিব মাতা নরবলি। আমি যে সন্তানের মা, আশায় করিয়া ক্ষমা কোলে তুলিয়া নাও। মা পূর্ণ করো তোমার পূজা।’ এরপর বজ্র পাতের শব্দে দীঘিতে খুব দ্রুত জল ওঠা শুরু হয়। লোকজন দৌড়ে পাড়ে উঠতে পারলেও দীঘির টইটম্বুর জলে রানী তলিয়ে যান। কমলা রানী আর তীরে উঠতে পারেননি। সেই থেকে কমলা রানী বা সুতানাল দীঘি নামে এটি পরিচিতি পায়। 
 
দীঘিমধ্যে ছোট্ট ভূ-খন্ডের উপর একটি সুন্দর ঘর ছিল সেখানে রাজা রাত্রি যাপন করতেন। ডিঙ্গি নৌকায় চড়ে প্রতিরক্ষা বাহিনী চতুর্দিকে টহল দিত।
 
কালক্রমে এই ভূখন্ডটি দীঘিতে রুপ নেয়। ১৯৪০ সালে সরকারি ভূমি জরিপে দীঘিটিকে রানি বিরহিণী নামেই রেকর্ড করা হয়েছে। তবে দীঘিটি খননের সত্যিকারের দিনক্ষণ ইতিহাসে জানা না গেলেও এটা যে একটা ঐতিহাসিক নিদর্শন এ বিষয়ে কারো কোনো সন্দেহ নেই। 
 
বর্তমানে প্রতিবছর অক্টোবরে  এ দীঘিতে মৎস্য শিকারের জন্য প্রতি বছর দূর-দূরান্ত থেকে মৎস্য শিকারীরা আগমন করে থাকেন।সারাদেশ থেকে আসা মৎস্য শিকারীরা সমিতির দেয়া টিকিটের মাধ্যমে মাছ শিকার করে থাকেন। এ দীঘির মাছ খুব সু-স্বাদু বলে বেশ প্রশংসাও রয়েছে। 
 
ঐতিহাসিক এ দীঘিকে কেন্দ্র করে ভূমিহীনদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হয়েছে বলে স্থানীয়রা জানান। ১৯৮৩ সালে এই দীঘিকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে ‘সুতানালি দীঘিরপাড় ভূমিহীন মজাপুকুর সমবায় সমিতি’। ১৯৮৪ সালে সমিতিটি রেজিস্ট্রেশন প্রাপ্ত হয়। বর্তমানে এই সমিতির সদস্য সংখ্যা ১১৭ জন। বর্তমানে সমিতির সভাপতি হিসেবে মোফাজ্জল হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক দিসেবে ইদ্রিস আলী দায়িত্ব পালন করছেন। এই দীঘির চারপাশে ১৮০টি পরিবারের ২১৫টি খানার লোকজন বাস করেন। কালের স্বাক্ষী হয়ে আজো রয়েছে এই ঐতিহাসিক সুতানাল দীঘি। 
 
 
 
 
 
 
 


বিষয়:



এই বিভাগের জনপ্রিয় খবর
Top